২৫ শে জুন উদ্বোধন হলো আমাদের বহুল প্রত্যিক্ষিত পদ্মা সেতু । বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা এই দিনে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন এবং প্রথম পদ্মা সেতুর টোল প্রদান করেন।
পদ্মা সেতুর পরিকল্পনি শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। মূল উদ্দেশ্য ছিলো দক্ষিন ও দক্ষিণ পশ্চিমাংশের সাথে যুক্ত করা।
২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর কাজ চায়নার কম্পানি চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজকে দেয়া হয়। কিন্তু নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২৬ শে নভেম্বর থেকে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ ছিলো প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু মাওয়া –জাজিরা পয়েন্ট কে সংযুক্ত করবে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এই অঞ্চলের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।

পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬.২৪১ কি. মি অর্থাৎ প্রায় ৩.৮৭৮ মাইলের মত। এর প্রস্থ হবে প্রায় ১৮.১৮ মিটার বা ৫৬ ফিট। সেতটির উচ্চতা প্রায় ১২০ মিটার অর্থাৎ প্রায় ৪০০ ফিট। সেতুটি দিয়ে ট্রেন ওয়ান ওয়েতে যাওয়া আসা করতে পারবে। সেতুটি ৪১ স্পেন দিয়ে তৈরি।
২৫ শে জুন উদ্বোধন হওয়ার পর সেতুটিতে উৎসুক মানুষের ঢল দেখা যায়।

তৈরি প্রক্রিয়া

প্রকল্পটি দুটি পর্যায় নিয়ে গঠিত। ১ম পর্যায় এর মধ্যে রয়েছে ডিজাইন ফেজ যা ক্রয় কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্মাণ চুক্তি প্রদানের জন্য ভূমিকা রাখে। পর্যায় দুই হল নির্মাণ পর্যায়। ফেজ ১ শুরু হয় ২৯ জানুয়ারী ২০০৯ এ। ঢাকায় একটি ডেডিকেটেড প্রকল্প অফিস ২০০৯ সালের মার্চ মাসে স্থাপিত হয়। মূল সেতুর বিস্তারিত নকশা AECOM-এর হংকং অফিসে করা হয়েছিল। ডিজাইন টিমের দ্বারা সম্পাদিত সমস্ত কাজ AECOM এর কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (QMS) এর কাঠামোর মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল যা স্বাধীনভাবে AS/NZS ISO 9001 তে স্বীকৃত। QMS টিম দ্বারা গৃহীত সমস্ত প্রকল্পের কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। প্রকল্পের শুরুতে একটি প্রকল্প-নির্দিষ্ট নকশা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মার্চ ২০০৯-এ, বাংলাদেশ সরকার AECOM-কে ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য নকশাটি ত্বরান্বিত করার জন্য অনুরোধ করেছিল। এর ফলে ডিজাইন টিমের মধ্যে অতিরিক্ত কর্মীদের একত্রিত করার প্রয়োজন হয়েছিল। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) নিয়মিত বিরতিতে নকশা পর্যালোচনা করার জন্য পাঁচটি জাতীয় এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করেছে। এছাড়াও, একটি স্বাধীন চেকিং ইঞ্জিনিয়ার, ফ্লিন্ট অ্যান্ড নিল, ডিজাইন টিম দ্বারা উত্পাদিত নকশার মানদণ্ড, স্পেসিফিকেশন এবং অঙ্কনগুলি পর্যালোচনা করতে নিযুক্ত ছিলেন যাতে নকশাটি প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণ করে এবং মূল সেতুর বিশদ নকশার একটি স্বাধীন চেক করার জন্য। এবং নদী প্রশিক্ষণ কাজ।

পদ্মা সেতুর টোল

পদ্মা সেতুতে বিভিন্ন যানবাহনের টোল:
প্রাইভেট গাড়ি/জিপ – ৭৫০/-
পিকআপ _ ১২০০/-
মাইক্রবাস – ১৩০০/-
মিনিবাস – ১৪০০/-
মিডিয়াম বাস – ২০০০/-
বড় বাস – ২৪০০/-
ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) – ১৬০০/-
ট্রাক (৫-৮ টন) – ২১০০/-
ট্রাক (৩ এক্সেল) – ৫,৫০০/-
ট্রায়লার (৪এক্সেল) – ৬০০০/-
ট্রায়লার (৪এক্সেলের উপর) – ৬০০০/- +

আপাততো এই রেটেই পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচলাচল করছে।

টোল হতে আয়:
২৬শে জুন পদ্মা সেতুতে ১৫২০০ যানবাহন যাওয়া আসা করে যা থেকে আয় হয় প্রায় ভোর ৬ টা হতে দুপুর ২ টা পর্যন্ত। একটা দৈনিক পত্রিকা ধারণা করছে যে, পদ্মা সেতুর টোল দিয়ে ৯ বছরের মধ্যে নির্মাণ ব্যয় শোধ করা সম্ভব।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
পদ্মা সেতু ছিলো ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ এর ৩,৮৪৩.৫০ কোটি টাকার প্রকল্প। রাজধানী ও দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কে পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ৩,৮৪৩.৫০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার চওড়া এই সেতুটিকে দেশের সম্ভাব্য দীর্ঘতম সেতু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে নির্মাণ কাজ শুরু করার এবং জুন ২০০৪সালে শেষ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত পরিমাণ ২৮৯৩.৫কোটি টাকা বিদেশী উৎস থেকে এবং ৭৫০ কোটি টাকা স্থানীয় উৎস থেকে আসে।

২০০৬-৭ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এপ্রিল ২০১০-এ প্রকল্পের জন্য প্রাক-যোগ্যতার টেন্ডারদের আমন্ত্রণ জানায়। সেতুর নির্মাণ কাজ ২০১১ সালের প্রথম দিকে শুরু হবে বলে আশা করা হয়েছিল এবং ২০১৩সালে বড় সমাপ্তির জন্য প্রস্তুত হবে (এবং ২০১৫ সালের শেষের দিকে সমস্ত বিভাগ সম্পূর্ণ হবে)
প্রকল্পের প্রস্তুতির সাথে জড়িত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগের পর, বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে এবং অন্যান্য দাতারা তা অনুসরণ করে। এরপর বাংলাদেশ সরকার নিজেই এই প্রকল্পে অর্থায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

চায়নার বিল্ড-অপারেট-ট্রান্সফার (বিওটি) এর ভিত্তিতে সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব করেছে ২ বিলিয়ন ডলার বা প্রকল্প ব্যয়ের ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ করে। চারটি কোম্পানি—চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, ডেইলিম-এলএন্ডটি জেভি এবং স্যামসাং সিএন্ডটি কর্পোরেশন—টেন্ডারের কাগজপত্র কিনেছে।

১৭ ই জুন ২০১৪ তে, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছিল। একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে পদ্মা নদীর ওপর দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত সেতু নির্মাণের জন্য নির্বাচিত করা হয়। ৬.১৫ কিলোমিটার সেতুটির আনুমানিক খরচ ৳৯১.৭২ বিলিয়ন (১.১ বিলিয়ন ডলার)।

যেভাবে তৈরি হলো:
২০২১ সালের মে পর্যন্ত, ৬.১৫ -কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বি-স্তর পদ্মা বহুমুখী সেতুর ৯৫% এর বেশি নির্মাণ (সমস্ত প্রধান স্টিলের ফ্রেমের স্প্যানগুলি পিয়ারে সেট করা হয়েছিল) সম্পন্ন হয়েছিলো। মূল সেতুর জন্য নিয়োগ পাওয়া চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (এমবিইসি) কাজটি করেছে। সেতুটিতে মোট ৪২টি পিলার রয়েছে। প্রত্যেকটির নিচে ছয়টি পাইল রয়েছে। পিলারের উপর স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছিল। সেতুটিতে মোট ৪১টি স্প্যান রয়েছে।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজটি মোটামুটিভাবে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিলো প্রধান সেতু, নদী প্রশিক্ষণ, দুটি সংযোগ সড়ক এবং অবকাঠামো (পরিষেবা এলাকা) নির্মাণ। নদী প্রশিক্ষণের জন্য চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য চুক্তি দেওয়া হয়।

অক্টোবর ২০১৭ সালে, মূল নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার দেড় বছরেরও বেশি সময় পরে, প্রথম স্প্যানটি ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছিল, যা প্রকল্পের সময়মত অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়।

২৭শে নভেম্বর ২০২০-এ, সমস্ত ৪২টি স্তম্ভের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল।

সেতুর চূড়ান্ত (৪১তম) স্প্যানটি ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে রাত ১২:১২ তে এ ইনস্টল করা হয়েছিল।

২৪ শে আগস্ট ২০২১ সকাল ১০:১২ তে পদ্মা সেতুর ১২ এবং ১৩ নম্বর পিলারের সাথে সংযোগকারী স্প্যানটিতে শেষ রাস্তার স্ল্যাবটি স্থাপন করা হয়েছিল।

বর্তমানে সেতুটি হলো বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু।

পদ্মা সেতুর ৪১৫ টি ল্যাম্প পোস্টের সবকটিতেই বিদ্যুতের প্রবাহ রয়েছে এবং অন্ধকার হতে শুরু করলেই সেগুলো আলোকিত হয়।