এই ব্লগটি করা হয়েছে আমাদের অন্যতম মিষ্টি কাপল আমিনা লোপা আপু ও মাহমুদ ভাইকে নিয়ে, গত বছরের নভেম্বর মাসে তারা হিমালয়ের অন্যতম অ্যাডভেঞ্চারাস স্থান অন্যপূর্ণায় ট্রেকিং করেন।

 

অন্নপূর্ণার অনুবন্ধ

পর্ব-১

এই বছরের শেষের দিকে মনস্থির করলাম বনির বাৎসরিক আর আমার তিন বছর অন্তর শ্রান্তির ছুটিতে বিমানযোগে দূরে কোথাও যাবো। কারণ লম্বা ছুটি নষ্ট করতে চাইনি। আকরাম ভাইও এক সময় বলেছিলেন অন্নপূর্ণা বেইজ ক‍্যাম্পের কথা। শুনলাম নভেম্বরে ইভেন্ট আছে। মনে মনে একরকম ঐ প্রস্তুতিই ছিলো। এদিকে কোভিড ভ‍্যাক্সিন এর কোনো এসএমএস আপডেট পাচ্ছিলাম না বলে টিকা কেন্দ্রে যোগাযোগ করে অবশেষে প্রথম ডোজ নিতে পারলাম। আর যেদিন নিলাম সেদিনই হঠাৎ দেখলাম বেইজ ক‍্যাম্পের ইভেন্ট অক্টোবরেই পঁচিশ তারিখ। সেপ্টেম্বরের তিরিশ চলে তখন। হাতে যে কটা দিন ছিলো এর মধ‍্যে এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ছুটির অনুমতি না পেলে কিংবা সেকেন্ড ডোজ ভ‍্যাক্সিন না পেলেও আমি যেতে পারবোনা। আর সেকেন্ড ডোজ পাবো আমি অক্টোবরের উনত্রিশ তারিখে। মাত্র কয়েকটা দিনের তফাৎ এ এই ইভেন্টে যাওয়া হবেনা। তাই আফসোস হচ্ছিল। নেপালে এবার যাওয়া হবেনা। কয়েকদিন পর আকরাম ভাই জানালেন আপু আপনারা অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকে চলেন। চৌঠা নভেম্বর আরেকটা ইভেন্ট দিয়েছি। আপনার ভ‍্যাক্সিনের সেকেন্ড ডোজও কমপ্লিট হয়ে যাবে এর মধ‍্যে। সত‍্যি মনে হলো হারানো আনন্দ ফিরে পেলাম কুড়িয়ে। সময় ততোদিনে আরো অনেকটাই চলে গিয়েছে। যাওয়া হবেনা ভেবে ছুটির জন‍্যও বিশেষভাবে আবেদন করিনি। পরেরদিন অফিসে গিয়েই যত দ্রুত পারলাম ছুটির ফাইল নিয়ে দৌড়ালাম। অফিসের স‍্যারের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধে ছুটির ব‍্যবস্থা হলো অনাকাঙ্খিত সময়ের মধ‍্যেই। আকরাম ভাইকে মহাখুশিতে কনফার্ম করলাম আমরা যাচ্ছি অবশেষে সাদাপাহাড় ইনশাআল্লাহ্। আমরা যারা যারা ফাইনাল যে যাচ্ছি তাদের নিয়ে গ্রুপ হলো একটা। সেই গ্রুপে পরিচিতি তারপরে একদিন একত্র হওয়া। অন্নপূর্ণা বেইজ ক‍্যাম্প, সার্কিট ট্রেক এবং সিটি ট‍্যুরের মেম্বাররা সবাই একসাথে একদিনে। কারণ আমাদের কেনাকাটা, যাওয়ার প্রস্তুতি এসব নিয়ে আলোচনা করতেই মূলত দেখা করার ব‍্যবস্থা করেছিলেন আকরাম ভাই। ঐ দিনের সবচেয়ে মনে রাখার বিষয় ছিলো যে তারানা বেইজ ক‍্যাম্প ইভেন্টে যাচ্ছে এমনকি তার টিকিট কনফার্ম হয়ে গিয়েছে পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের সাথে কথা হওয়ার পর হঠাৎ ই ওর মনে হয়েছে সার্কিট ট্রেকেই তার যাওয়া উচিত। কারণ বেইজ ক‍্যাম্প ইভেন্টে আর কোনো মেয়ে যাচ্ছেনা। তার চেয়েও বড় কারন ওর মনে হয়েছে আমাদের সাথেই ওর মজা হবে বেশি। জানিনা শুরুতেই কি জানি একটা সুন্দর সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো। আসলে সবাই যখন একই প্রেমে অন্ধ। ভালো লাগাটাও একই ফ্রেমে বন্ধ। টিকিট পরিবর্তনে বাড়তি টাকাও খরচ হয়েছিলো তারানার তাতে। অন্নপূর্ণা তারপর থেকে আমাদের আহার, নিদ্রা, ক্রিয়া-কর্মে বসত করতে শুরু করেছে। ঈদ আসার আগে ঈদের যে আনন্দ হয় ঠিক তেমন । তারপরেও শাকিল ভাইয়ের পাসপোর্ট রিনিউয়‍াল সহ আরও কনফার্ম হতে না পারা তন্নি ছুটির ব‍্যবস্থা করতে পারবে কিনা নাকি ভাইয়ার একাই যেতে হবে। সেই অনুযায়ী কেনাকাটার ধরণও আলাদা হবে। এই যে অনিশ্চয়তা এবং অন‍্যদিকে সাদা পাহাড় এ পা রাখবো এই আশায় মনের অস্থিরতার চরম মুহূর্ত। তারপরেই শুরু হলো টুকটাক সেই অনিশ্চয়তা নিয়েও পুরোদমে জুতা, উইন্ডব্রেকার, ডাউন জ‍্যাকেট সহ থার্মাল, ট্রাউজার কেনার পালা যা এর আগে সবুজ পাহাড়ে লাগেনি কখনও। তাও যদি সব চাইতেই যেখানে খুশি কিনতে পেতাম। সাদাপাহাড়ের জিনিসপত্র নাকি গুটি কয়েক দোকানেই মেলে। অনলাইন থেকে ট্রেকার্স শপ সব অফিসের পর কিংবা ছুটির দিনগুলোতে ব‍্যস্ত আমরা মহা ধুমধামের সেই ট‍্যুর শপিং এ। এই দিনগুলোও কি কম ভালো ছিলো। আমার ট‍্যুরমেটরাই আরো ভালো বলতে পারবে। দিন ঘনিয়ে আসছে কেনাকাটা যেন কতই কত। ব‍্যাগ গোছানো। কি নেয়া যাবে কি নেয়া যাবেনা। ওজন যত কমানো যায়। কোনটা ব‍্যাগের কোন পকেটে কত শত ভেবে ব‍্যাগ গোছানো তখনও শুরুই হয়নি। সবাই সবার কাছে জানতে চাই কার ব‍্যাগ গোছানো শেষ। ওজন কার কত। কতই না উপদেশ ওজন কমাতে হবে ভাই। আবার শীতের পর্যাপ্ত কাপড় না নিলেই নয়। এদিকে সময়ও দু’একদিন নয়। কারও বিশ দিবস তো কারও পনেরও। মাথা যেন স্বয়ংক্রিয় মেশিন একটা তখন। এদিকে ছুটিতে যাওয়ার আগে অফিসে যা ঘটে। প্রয়োজনের চেয়ে একশগুণ কাজ চাপে। তবুও পেরে উঠছি আমি, সাদাপাহাড়ের নেশা চেপেছে তো অলরেডি। এবার বিপত্তি আমার ভ‍্যাক্সিনের দ্বিতীয় ডোজের কোন আপডেট নেই। ঘেটে দেখি সফটওয়‍্যারে প্রথম ডোজেরই এন্ট্রি দেয়নি। টীকাকেন্দ্রে যোগাযোগ করায় আমাকে জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে ঠিক করিয়ে আনতে হবে। দুই থেকে তিন দিনের দৌড়াদৌড়ির ফলে অবশেষে আমি ভ‍্যাক্সিনেটেড এবং সার্টিফাইড হলাম। এবার কে আটকায় যদি উপরওয়ালা আমাকে সাদাপাহাড়ে হাঁটার ভাগ‍্য দেন। সত‍্যি ট্রেকিং এর আগে ট্রেকিং প্রস্তুতি আরেকটা ট্রেকিং। এবং ব‍্যাগ গোছানোর দক্ষতা এক বিরাট অভিজ্ঞতা। যা আমার একদিনে হয়নি বা টিউটোরিয়াল দেখেও হয়নি। সবুজ পাহাড়ের প্রস্তুতি আর সাদা পাহাড়ের এই দুটোতেও তফাৎ বিস্তর। যাই হোক চৌঠা নভেম্বর আমরা রওনা হলাম ফজরের পর পরই। ফ্লাইট টাইম ছিলো নয়টায়। কিন্ত ৯:৪০ মিনিটে আমরা বিমানে চেপে বসলাম। কয়টায় উড়তে শুরু করেছিলাম ঠিক মনে নেই তবে এক ঘন্টার উড্ডয়নের শেষে আমরা ১১: ৪০ মিনিটে পৌছালাম নেপাল এয়ারপোর্টে। আর উড়ার সময় আধা ঘন্টা পর থেকেই সবুজ পেরিয়ে সাদা পাহাড় চূঁড়ারও বহুউচ্চে মেঘ ভেদ করে যাচ্ছি উড়ে অন্নপূর্ণার এক স্বপ্নে বিভোর চোখ জোড়া মেলে। অবতরণের খানিক আগেই অসম্ভব সুন্দর সব রোদে মোড়ানো সাদা জলমলে এক একটি স্বর্গ বাড়ি পার করে যাচ্ছিলাম। অসম্ভব সুন্দর সে দৃশ‍্য। পৃথিবীর উপর থেকেই পৃথিবীর লুকায়িত রূপ যেন সব একসাথে ধরা পড়ে। আমার প্রথম বিমান ভ্রমণ ছিলো এটা। এ রূপ আমি চোখে নয় মনে ধরে এনেছি। প্রতিদিন মনে করি আর ছোট্ট বেলার বিমান উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে দৌড়ে উঠান পেরিয়ে মাঠে যাওয়ার অনুভূতি পুনরায় অনুভব করি। উপর আর নিচে কোনো দিকেই সৃষ্টিকর্তা কমতি রাখেননি। আলাদা রূপের হলেই বা কি সৌন্দর্যে কেউ কাউকে হার মানাবার নয়। সৃষ্টিকরতাই শ্রেষ্ঠ শিল্পী, এ সৃষ্টির একমাত্র চিত্রকর। কি সুন্দর ভারসাম্য রেখেছেন পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের। এয়ারপোর্টে নেমে থামেল, থামেল থেকে বেসিশহরের গল্প কথা থাকছে দ্বিতীয় পর্বে….

বি. দ্র. প্রতিটি ট‍্যুরের জন‍্য নিজেকে অনেক পরিশ্রমী, সক্রিয়, সুস্থ এবং সহনশীল থাকতে হবে সবার আগে। তার পর আপনি যা অর্জন করবেন তা আপনাকে সারাজীবন উপভোগ করার সুযোগ দিবে। সবকিছুই অর্জন করতে হয়।

দিওয়ালির অপর তিহার

(নেপালের ১ম দিন)

পর্ব-২

মন্দিরের শহর কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশনের সমস্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে বের হতে প্রায় বেলা পৌনে দুইটা বাজে তখন। এয়ারপোর্টের ওপারে দাঁড়িয়ে আমাদের সদাহাস‍্য উজ্জ্বল হরিদ্রা আবোরণ এ আকরাম ভাই, চনমনে মানুষ সজন ভাই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তারপর থামেল পৌছালাম প্রায় বেলা দুইটার দিকে। সেখানে আল মদিনা হালাল খাবারের দোকানে দুপুরের খাবার খেয়ে টুকটাক প্রয়োজনীয় যার যা কিছু কেনার বাকি ছিলো সেইসব কিনে নিলাম। বিকাল তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মাঝামাঝি সময়ে হাইয়েস গাড়িতে চেপে রওনা হলাম বেসিশহরের দিকে। পাহাড়ের কোল ঘেষা পথ ধরে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। সূর্য যেন পাল্লা দিয়েছে আমরা বেসিশহর ঢোকার আগেই সে অস্ত যাবে তার বাড়ি। সন্ধ‍্যা নামছে প্রায়। হঠাৎ করেই যেন অন্ধকার নেমে এলো বেশি। সেদিন ছিল কার্তিকের ঘোর অমাবস‍্যার রাত আর নেপালিদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বড় উৎসব তিহার যা আমরা দিপাবলী অথবা দিওয়ালি নামেই জানি । এই অনুষ্ঠান তারা পাঁচদিন ব‍্যাপী পালন করে থাকে। গত তিনদিন ধরেই নাকি এ শহর সেজে আছে তা জানতামই না। আমার তো মনে হচ্ছিলো নেপাল বুঝি আমাদের স্বাগত জানাতেই এই আলোকসজ্জায় সেজে আছে। এদেশে এই প্রথম অথচ কি আপন আর আন্তরিক লাগছিলো সে পথ, সে আলো অন্ধকার, না বুঝতে পারা ভাষা আর না পড়তে পারা নিয়ন আলোয় জ্বলতে থাকা বিলবোর্ড সাইনবোর্ডেরা। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ করেই যেন প্রদীপ শিখাও জ্বলে উঠল কোথাও। জানালার কাঁচে চোখ পড়তেই সুন্দর কিছু আলোকচ্ছটা চোখ ছুঁয়ে গেলো। গাড়ি থেকে নামার আবদার জানালাম। নেমে দেখি প্রদীপ সমষ্টি। আহা তাইনা এতো রূপের বাহার! কয়েকটা ছবি নিবো ভেবে সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই নিষেধ এলো ড্রাইভারের এটা নাকি মন্দির। জুতা পায়ে ওঠা নিষেধ। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আসলেই তাই। ছোট্ট একটা মন্দির আর অমাবস‍্যার অন্ধকারেও এ আলো এতো বেশি যে, মন্দির এর চেয়ে আলোই বেশি নজর কাড়ছিলো। একটু পর পর ফুলের দোকান আর তাতে গাঁদা ফুলের প্রজাতিই বেশি যা চোখ ও মন উভয়কেই প্রফুল্ল করে। আগেই বলেছি ধর্মীয় উৎসবের কথা আর সে কারনেই সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকলেও দোকানের সামনে কিছু নাম না জানা এবং সারি সারি গাঁদা ফুলের গাছ সত‍্যিই তাদের রুচির পরিচয় বহন করে। আরও যত এগিয়ে যাচ্ছি শহর ছেড়ে পাহাড়ে পাহাড়ের কোল ঘেষে,ততোই যেন প্রতিটি বাড়ি দোকান এক একটি বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি আমেজ দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি বাড়ির সামনে এতো দারুন সব রাঙ্গোলির রংমাখা আলপনা চিত্র! দেখেই মন চায় দৌড়ে দেখে আসি বাড়ির ভেতরটা। আর মনে হচ্ছে ঐ রাঙ্গোলি চিত্র ইশারা দিচ্ছে তুমি আমন্ত্রিত হে অতিথি। রবিঠাকুরের গানের কথা মনকে আরও যেন বেশি কল্পজগতে নিয়ে যায়…চলেছ পথিক আলোকযানে আঁধার-পানেমনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া….হে ক্ষণিকের অতিথি এভাবেই ফেইরি লাইটস এ আলোকিত শহর পেছনে রেখে এক পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে অন‍্য পাহাড়ের পদের-প্রান্তে, ঝিরি ঝর্ণা খালের জলে কিংবা উঁচু নিচু ঢিবি পেরিয়ে গাড়ি চলেছে এঁকে বেঁকে। আকাশ সেদিন অন্ধকারের রাজ‍্য। হেডলাইটে যতটুকু সামনে দেখা যায় মাঝে মাঝে চোখ ধাঁধাঁয় পথের কি তবে এখানেই শেষ! বাঁকা কি আর যেন তেন!! ১৮০ ডিগ্রী কোনে তখন স্টিয়ারিং ঘুরে আর গাড়ির পেছনের একদল রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ তখন রোমাঞ্চ খুঁজি তাতে। এভাবেই প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টার গাড়ির জার্নি শেষে অন‍্য আরেকটি ফেইরি লাইটস এ সাজানো ফেইরিদের এক সুন্দর শহর বেসিশহরে পৌছালাম রাত সাড়ে নয়টায়। যেখানে প্রতিটি হোটেল, বাড়ি, দোকান আলোয় আলোয় আকাশ ভরা তারার এক জীবন্ত শহর। হোটেলের সামনে আবির রাঙ্গোলি আর প্রদীপ শিখার শিয়রে বসে সেই শহর দেখে নিলাম যতদ‍ূর দেখা যায়। দু’চোখে শুধু তারার শহর।কবিগুরু বলেছিলেন,এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনেকী উৎসবের লগনেসব আলোটি কেমন ক’রে ফেল আমার মুখের ‘পরে,তুমি আপনি থাকো আলোর পিছনে…
এই শহর কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ১৭৫.৬ কি. মি. দূরে রাজধানী থেকে উত্তরে ৭৬০ মিটার (২৪৯০ ফিট) উঁচুতে অবস্থিত। যেখানে কাঠমান্ডুর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪০০ মিটার (৪৬০০ফিট) উপরে। বেসিশহর একটি পৌরসভা এবং নেপালের গন্ডাকি প্রদেশের লামজুং জেলার জেলা সদর দপ্তর। এই শহরের উত্তর থেকে অন্নপূর্ণা -২, মাছাপুছরে, লামজুং হিমাল দেখা যায়।রাত দশটায় আমরা ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে যার যার প্রিয়জনদের সাথে ফোনে কথা বলে ঘুমাতে যাই। আর বেসিশহরের সেদিনের রাত ছিলো আমাদের একটা ফেইরি নাইট। জানালা ভেদ করে কত না রঙিন জোনাকি ঘরে ঢুকে পড়েছে। তাদের উপস্থিতি সব ক্লান্তি নিদ্রায় পরিণত হলো আমার। আমরা আছি বেসিশহর। তন্নি আমার বেডেই ঘুমিয়ে আর তারানা পাশের বেডে। মেয়েটা অন্ধকারেও সেই ফেইরি লাইটের আলোয় টাইম সেট আপ দিয়ে ছবি তোলে। (স্বজন, আকরাম, মিজান, শাকিল ) ভাইয়েরা এবং বনি পাশের দুই রুমে। আমি পরেরদিন ভোরের আলোয় ফেইরির শহরে ঘুম ভেঙে কি দেখবো তাই ভেবে জোনাকিদের বিদায় জানিয়ে শুভ রাত্রি আপাতত….০৪.১১.২১ ইংবেসিশহর থেকে চামের গল্প ভোর হওয়ার পরে…..

পর্ব – ৩
বিদায় বেসিশহর,
গন্তব্য এবার চামে
৫ই নভেম্বর, ২০২১ইং
সেদিন সকালে ঘুম ভেঙেই জানালায় নতুন আরেক শহর দেখছি রবির আলোয়। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা শেষ করলাম। হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটতেই হোটেল বাড়ির বিল্ডিং গুলোর ফাঁক ফোকর দিয়ে পাহাড়ের হাতছানি পাচ্ছিলাম। যেন স্বাগতম জানাচ্ছিল এই বলে যে সামনের পথগুলোর জন‍্য অভিনন্দন। তোমরা আর কয়েকদিনের মাঝেই আমার খুব কাছে আসবে। তখন এই সবুজ ছেড়ে আমার সফেদ রঙা রুপ দেখতে পাবে। হিম শীতল অনুভূতি পাবে। শুভ্রতায় মুগ্ধ হবে। সেই মুগ্ধতার বিভোরতা নিয়েই বেলা এগারোটা থেকে সোয়া এগারোটার মধ‍্যে আমরা বেসিশহর এসিএ এন্ট্রি পারমিট কাউন্টার এন্ড ইনফরমেশান সেন্টার থেকে পারমিশান পত্র নিয়ে রওনা হলাম চামের উদ্দেশ্যে। জীপ যোগে রওনা হওয়ার আধা ঘন্টার মাথায়ই দেখা পেলাম সাদা পাহাড়ের চূড়া। দুই পাহাড়কে ছাপিয়ে উঁকি দিয়ে আমাদের যেন অভিবাদন জানাচ্ছে সে। ভুলভুলের একপাশে ঝর্ণা আরেক পাশে মারসিয়াংদি নদী তড়িৎ বেগে বয়ে চলেছে। ঝর্ণা গিয়ে নদীতে নাকি নদীই ঝর্ণায় মিশে একাকার বোঝার উপায় নেই। মাঝ দিয়ে রোলার কোস্টারের ন‍্যায় পথ। নেমে পড়লাম নদী ঝর্ণা সাদা পাহাড়ের হাতছানিতে। সুন্দর দৃশ‍্য দর্শনের শুরু। আবার রওনা হওয়ার ঘন্টা দেড়েক পরেই দেখা মিললো ছামচে ঝর্ণার অসম্ভব সুন্দর মিউজিক সহ জলচ্ছল। দুপুরের খাবার খেলাম সেই ঝর্ণার অপূর্ব সুন্দর জলের ধারার তীব্র বেগধ্বনি শুনতে শুনতে। রেস্টুরেন্টের খোলা জানালায় তাকাতেও ভয় পাচ্ছিলাম এহেন রূপ মাধুর্য আর জল সংগীতের মুর্ছনা আসলেই স্বপ্ন নয়তো!! ঝর্ণার পাশে বসে ক্ষুধার্ত পেটে সৌন্দর্য গিলতে গিলতে পেট ফুলিয়ে ঢোল। তারপরেও পাহাড়ি ফ্রাইড রাইস আর ঝর্ণার তলে চায়ের কাপ রেখে ঝর্ণার পানির অমৃত গরম লাল চা পান যেন এক রকম আফটার লাঞ্চ লোভনীয় ডেজার্ট। বেলা পৌনে চারটা কিংবা চারটার দিকে আবার জীপে বসলাম। সূর্য তখন আড়ালে চলে গেছে। বেলা আর বেশি নেই। যতই এগোচ্ছি শীত আগের চেয়ে একটু বেশি অনুভূত হচ্ছে। গায়ে উইন্ডব্রেকার চাপিয়ে এক জীপে আমাদের গাইড গাড়ির হেলপার আর ড্রাইভার সহ এগারোজনের চাপাচাপি করে বসেও চরম আনন্দে উচ্ছাসে এগিয়ে চলেছি। যদিও জীপ আটজনের জন‍্য প্রযোজ‍্য। তবুও সে কষ্টের তুলনায় আনন্দই ছিল ঢের বেশি উত্তেজনার। পনের বিশ মিনিট পরেই ধারামপানি নামক জায়গায় আমাদের জীপ থামাতে হলো একটি পারমিশান চেক পয়েন্টে। সেখানে সবার নাম এন্ট্রি করতে সময় লেগেছিলো খানিকক্ষণ। এর মাঝে রাস্তার ঢালু গড়িয়ে নিচের দিকে দূর থেকে তালের সৌন্দর্য আর উপরে পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা নামার গোধূলি রূপ মাধুর্য আমাদেরকে চৌম্বকার্ষনে টানছিলো। ছবি তুলেছিলাম আমরা খুব মজা করে এই জায়গাটাতে। আমাদের ইচ্ছে করছিলো তাল গ্রামটাতে থেকে যাই না হয় একরাত। রংবেরঙের তালের ছাদ, ফুটবলের মাঠ, পাহাড়ের কোলঘেষা ছোট ছোট ঘর বাড়ি, পাশেই বয়ে চলা সুতোর ন‍্যায় মারসিয়াংদি নদী আমাকে পুতুল খেলার দৃশ‍্য মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। আবার আনুমানিক প্রায় পাঁচটায় আবার উঠে বসলাম জীপ গাড়ি। মিনিট দশেকের মধেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে দু’পাশের পাহাড়কে ঢেকে দিলো। কিচ্ছু দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম কত বিপদজনক রাস্তা ধরে আমাদের জীপযান রোলার কোস্টার গতিতে যাচ্ছে। সামনে বেশ আরও অনেকগুলো ঝর্ণা পেয়েছি কিন্তু দেখার সৌভাগ্য কিংবা লোকেশন চেনার উপায় ছিলোনা। আমরা তখন গভীর ঘন রোমাঞ্চকর পথে আছি। মাঝে মাঝে জীপের জানালায় তাকালে গা শিউরে উঠছি শুধু। কখনও ঝর্ণার পানি মাড়িয়েও জীপের ইঞ্জিন চলছে। অমাবস‍্যার রাতেও এতো অন্ধকার দেখিনি যে নিকষ কালো অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে আরও একটি চেকিং পয়েন্ট পার করে আমরা একসময় লোকালয়ে পৌছালাম। সময় তখন সোয়া সাতটা আর আমরা এখন চামে। পছন্দমতো হোটেল খুঁজতে বেরিয়েছে আমাদের আকরাম ভাই আর সজন ভাই। হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। প্রচন্ড ঠান্ডা অনুভব করছি। বাধ‍্য হয়ে হাত মোজা পড়তে হলো, কান ঢাকতে হলো। ব‍্যাকপ‍্যাক গাড়ির ছাদ থেকে নামাতেই হালকা বৃষ্টিতে ভিজেছে মনে হলো। এরই মাঝে একদল নাচ গানের দলের দেখা। না বুঝতে পারা গানের লিরিক্স আর আনন্দ নৃত‍্য‍ে ছন্দে ছন্দে এগিয়ে গেলো তারানা আর তন্নি। দর্শক আর ভিডিও ধারণে আমি, শাকিল ভাই, মিজান ভাই, বনি। কিছুদূরে চোখ পড়তেই অজস্র প্রদীপ আলোতে চোখ আটকাতেই আমি, তন্নি, তারানা আবার ছুট সেই দিওয়ালি শিখার দিকে। হোটেলের সন্ধান মিলতেই চলে গেলাম। যার যার মতো ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার শেষ। এরপর উনো খেলার ট্রেনিং নিতে তারানার স্কুলে। স্টুডেন্ট আমরা সবাই। পানি কিন্তু বরফ ঠান্ডা। না পারতে পানি না ছুঁই এদিন থেকেই তার শুরু। ঠকঠকানি ঠান্ডা আর জড়োসড়ো আমরা সেদিনের রাত কেটেছে ডাউন জ‍্যাকেট, হাত-পা মোজা, উলের টুপি, আর ডাবল লেপের ভেতরেই। প‍্যাকেটের ভেতর থেকে বিদায় আজ। চামের সকাল থেকে আপার পিসাং এর পথে ট্রেকিং গল্প পরের পর্বে……

 

পর্ব – ৪
চামে এক শীত-বসন্ত
আমরা এখন ২৬৫০মিটার (৮৬৯০ফিট) উচ্চতায় উত্তর নেপালের মানাং জেলার সদর দফতর চামে। ডাবল কম্বল আর জ‍্যাকেট প‍্যাকেটের ভেতরে থেকেই আজকের ট্রেকিং উত্তেজনা নিউরনে অনুরণন হতে হতেই ভাবছি। সেদিন ভোর হতেই নিদ্রা ভেঙে যায়। হাত মুখ ধুতে গিয়ে বুঝতে পারলাম সামনের দিনগুলোতে ঠান্ডা কত ভয়ঙ্কর হতে পারে। হাতে পানি ধরতেই হাত নীলবর্ণ জমে শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। পুরো ওজুটা শেষ করাও তখন এক কঠিন অ‍্যাডেভঞ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে ঠকঠকানি কাপুনি নিয়ে একগাদা গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে ফজর নামাজ আদায় করলাম। এরপর আমরা প্রস্তুত হয়ে নিলাম। ব‍্যাগপত্রও গুছিয়ে ফেললাম। কারন আজ থেকেই আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে। যত দ্রুত আমরা বেরিয়ে পড়তে পারবো ততো দ্রুত পরের গন্তব‍্যে পৌছাবো। ওদিকে সূর্য পাহাড়ের সামান‍্য আড়াল হতেই হিম ঠান্ডায় জমতে হবে না হয়। নিচে নেমে গরম চায়ের কাপ হাতে ধরতেই উষ্ণ এক আরাম বোধ করলাম। যে উষ্ণতা তা আমাদের দেশে হবে তপ্ত গরম। কাপ হাতে হোটেলের সামনে নেমে এসেছি। গতরাতে এইখানটায়ই অনেক মানুষজন ছিলো, নাচ গান হচ্ছিলো। আমাদের গাড়ি এসে থেমেছিলো। তখন চারিদিক ছিলো নিকষ কালো অন্ধকার। আর এখন পাহাড়ের চূড়া গুলো সূর্যের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি যেন!! এতো কাছেই ছিলো এই পাহাড়গুলো অথচ রাতে বোঝাই যায়নি। অর্ধেক টা নীলচে সবুজ আর চূড়া গুলো বসন্ত আগুন খানিক আবার শুভ্র বরফ। প্রকৃতির কি বিচিত্র রূপ!! একই সাথে কত রঙের বেশ ধরতে পারে সে। এ রূপ যেন তার চির বসন্তের চিত্রভূমি। এতো সুন্দর একটি ভোর দেখবো সেদিন কখনও ভাবিনি। যেদিন থেকে নেপালে আছি শুধু আলো আর রঙের পরশ পাচ্ছি। সবখানে রঙের আচড়, আলোর নাচন। এই রং রূপ যে আরও বেশি উজ্জ্বল জীবন্ত আরও বেশি নিকটতম। এ তো ফাগুন জাগিয়ে দেয়া ভোর।  চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। হিম বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে। প্রাচিরের ওপর কাপ বসিয়ে এদিকে আমার মনও ফাগুনেরও মোহনায় সুর তোলে আর গুনগুনিয়ে গায়…
ফাগুনেরও মোহনায় মন মাতানো মহুয়ায় রঙিন এ বিহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায় ফাগুনেরও মোহনায়…সেই গুণগুণ সুরে মনের আনন্দে চরম উত্তেজনা নিয়ে ট্রেকিং গল্প পরের

 

পর্বে ৬ই নভেম্বর, ২০২১ইং

 

পর্ব – ৫
অন দ‍্য ওয়ে টু আপার পিসাং (১ম অংশ):

চামে থেকে সকাল আটটায় হাঁটা শুরু করেছি। গায়ে থার্মাল, ডাউন জ‍্যাকেট, উইন্ডব্রেকার চাপিয়ে পা থেকে মাথা মুড়িয়ে হাত পা মোজা সহ ট্রেকিং পোল হাতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। পাঁচ দশ মিনিট হাঁটার পর গরম লাগতে শুরু করলো। পথে দাঁড়িয়ে সবাই যার যার জ‍্যাকেট খুলে ব‍্যাগে ভরলাম। মাথার উপর সূর্য‍‍্যতাপ তখন প্রখর হতে শুরু করেছে। চারিদিকে ঝকঝকে সোনা রোদ। কিন্তু হাতের মোজা খুললেই হিম শীতল বাতাস হাত শক্ত করে দিচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটার পর থেকেই ফুলে ফুলে আর রঙ বে রঙের পতাকায় সাজানো রংধনু রূপ এক একটি হোম স্টে দেখতে পাচ্ছি আমাদের হাঁটার রাস্তার দু’পাশ দিয়ে। সামনে চেয়ার টেবিল পেতে রাখা এমন একটি হোম এ আমরা গিয়ে বসলাম একটু বিশ্রামের জন‍্য। সোজা কথায় এক টুকরো স্বর্গ যেন পাহাড়ের কোল থেকে নেমে এসেছে। সেই জায়গা সেই মুহূর্ত সত‍্যি পৃথিবীর অপূর্ব স্বর্গরাজ্য। স্বচ্ছ নীল আকাশের নিচে ছোট ছোট পরিচ্ছন্ন রঙিন এক একটি ঘর আর প্রতিটি ঘরের সামনে ফুলের বাগান। বসলেই সমস্ত ক্লান্তি উড়ে যায়। সাথে আলসেমিটাও ঝেঁকে বসে। তাই বেশিক্ষণ এই সব স্বর্গ কুটিরে না বসাই ভালো। এ‍্যাডমিনের অ‍্যাডভাইস এ তাই আবার হাঁটা শুরু। আমরা হেঁটে চলেছি রাস্তার একপাশে পাহাড়ের গা আর এক পাশে পাহাড় ঘেষা মারস‍্যাংদি নামক নদীর পাশ দিয়ে। নদীর পানি বয়ে চলার যে শব্দ বেগ তা দুইপাশের উঁচু পাহাড় কে ছাড়িয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। আর আমাদের কান দু’টো শুধু জল পাহাড়ের আধ‍্যান সংগীত ছাড়া তখন আ কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছেনা। সবাই একটা সময় যার যার মতো নিশ্চুপ হয়ে হেঁটে যাচ্ছি আনমনে। হারিয়ে গিয়েছি যে যার মতো করে প্রকৃতি আর জলের ছন্দে। এই সংগীত স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলা তৈরি করেছেন হয়তো রোমাঞ্চপ্রিয় পাহাড়ী পথের পথিকদের এক আধ‍্যাত্বিক অনুভূতি অনুভব করাতে। একটা জায়গায় গিয়ে আমরা থেমে যেতে বাধ‍্য হলাম, সৌন্দর্যের কাছে যেন একটু হাঁটু পেতে বসে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। সবুজ নদী তার স্বচ্ছ জলের স্রোতে একটু ক্লান্তি বিছিয়ে দেয়া। ততোক্ষনে আমরা আরও এক ঘন্টা হেঁটে এখানে পৌছেছি। বড় ছোট মাঝারী ত্রিকোণ চারকোন বক্র সমান বিভিন্ন সাইজের পাথর খন্ড পেরিয়ে আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম একদম মারস‍্যাংদী সেই মায়াবী নদীর কাছে। যাকে দূর থেকে দেখে আর জলের প্রতিধ্বনি শুনে শুনে হেঁটে আসলাম এতক্ষন তাকে যেন মন চাইলেই ছুঁতে পারি, পা ভেজাতে পারি। যে যার মতো এক একটা পাথরের গায়ে বসে ভাবনায় ডুব মেরেছি আমরা তখন। তপ্ত রোদেও মলিন অনুভব। কি সুন্দর শান্তির ছিলো সে মুহূর্ত। কিছুক্ষণ পর আবার এ‍্যাডমিনের তাড়া খেয়ে উঠে পড়লাম যথাযথ হাঁটা শুরু করলাম। এদিকে দুপুরের রোদ পিঠের ব‍্যাকপ‍্যাক আর পেটের ক্ষুধা সবই তার উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। সবাই বলছিলো আমার ব‍্যাগের শ‍্যাম্পু লোশন ফেইসওয়াশ এই টাইপের যা আছে আমি যেন ঢেলে ফেলে দিয়ে কমিয়ে ফেলি। যতখানি ওজন কমানো যায় ততো আমার জন‍্য ভালো না হয় কষ্ট হয়ে যাবে। কোনো দরকার নাই শ‍্যাম্পু সাবানের তবুও ওজন কমানো দরকার এমন সাজেশন ছিলো সবার। তখন আমরা সবাই মোটামুটি ক্লান্ত। ব‍্যাকপ‍্যাক নিয়ে ট্রেকিং পুরোপুরি অনুভব করছি। আর কিছুদূর হাঁটার পর আমরা দুইপাশে সারি সারি আপেল গাছের দেখা পেলাম। বুঝতে পারলাম আমরা এখন একটি আপেল বাগানের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছি। আর কিছুদূর যেতেই বাগানের এক পাশে সুন্দর মনোরম একটি ফার্ম হাউস পেলাম। এতো বেশি সুন্দর সাজানো গোছানো ফার্ম হাউসটা যে এখানেও আমরা বিশ্রাম বিরতি নিলাম। শুধু আমরাই না আরও অন‍্যান‍্য ট্রেকাররাও এখানে থেমে যান মনে হচ্ছিলো। একটু বিশ্রাম আর সাথে ফ্রেশ কিছু আপেল। আরও টুকটাক কিছু শুকনো খেজুর বাদাম আর কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিলাম। পানি হিসেব করে খাচ্ছি। কারন সামনে অনেকটা পথ আছে। পরবর্তী গন্তব্যে না পৌছানো পর্যন্ত এই পানি দিয়েই তৃষ্ণা মেটাতে হবে। আমরা তখন ব্রাহতাং নামক স্থানে বসে আছি। যা চামে থেকে ৭ কিমি উত্তর-পশ্চিমে মানাং গ্রামের পথে ফার্ম হাউসটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। প্রকৃতির কোলে বসতে এবং বিশ্রাম নেওয়ার একটি আদর্শ জায়গা এটি। হাউসটি ৩৭ হেক্টর এলাকা জুড়ে একটি আপেল বাগানের মধ্যে অবস্থিত।চলছে আপেল বাগান সাইড ফার্ম হাউসে আড্ডা বিরতি, পানাহার, ছবি তোলা, ফরেইনারদের সাথে পরিচিতি, ট্রেকিং নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ভিন্ন ভিন্ন দেশের রোমাঞ্চপ্রিয় ট্রেকারদের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনার উচ্ছলতা। বাংলাদেশী টিম ঐ সময় শুধু আমরাই। সুইজারল্যান্ড জার্মানী ফ্রান্স আর কত না দেশের রোমাঞ্চপ্রিয়, পাহাড়প্রেমী….. যাকে বলে মিশ্র ভালো লাগার এক ঠান্ডা হাওয়ার তপ্ত দুপুর। উদ্দেশ্য আজ আপার পিসাং পৌছে আহার করা।
©আমিনা লোপা ০৬ই নভেম্বর, ২০২১ইং

পর্ব-৬
অন দ‍্য ওয়ে টু আপার পিসাং (২য় অংশ)
০৬ ই নভেম্বর, ২০২১ইং
আপেল বাগান থেকে সাড়ে এগারটার দিকে আবার হাঁটা শুরু করলাম। উত্তপ্ত সূর্য তখন মাথার তালু ছুই ছুই। পাহাড় গাত্র কেটে যে পথ তৈরি হয়েছে, মারসিয়াংদী নদীর ডান দিক ধরে সেই পথ ধরে চলছি। কিছুক্ষণ পরেই পেলাম সাসপেনসান ব্রিজ যাতে সুইং করে উঠে গেলাম একেবারে পাইন বনে। ঘন বনে দাঁড়িয়ে লোভ হলো আরেকটু বসে যাই এখানে। অন‍্যান‍্য ট‍্যুরমেটরাও যেহেতু আমাদের পেছনে। তাদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়। সেই সুযোগে দু চারটে খেজুর, বাদাম আর দুই ঢোক পানি গিলে শক্তি চার্জ করে নিলাম। আমরা তো তখন আটজনের একটি গ্রুপ ট্রেইলে হাঁটছি। সেখানে অবাক হয়েছি এক এ‍্যাংলো-ইন্ডিয়ান ফরেনার নারী সোলো ট্রেকিং এ বেরিয়েছেন। উচ্চতায় যতটা না আমাদের বড় হবে ব‍্যাগটা তার আমাদেরটারও তিনগুন। মেদহীন ধবধবে সাদা শরীর আর উৎফুল্ল প্রাণবন্ত মন তাহার। তুমি একা এসেছো জানতে চাইতেই তাহার প্রাণোচ্ছল হাসিতে উত্তরটা ছিলো এরকম…. একা কোথায় এই যে তোমরা আছো। এই কথাটা যেন ঐ সময় তৃষ্ণার্ত প্রাণে এক গ্লাস চিনির সরবত। আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে এগোতে থাকলো সে। প্রথম দিনের ট্রেকিং বলে হয়তো শরীরেও একটা জড়তা ছিলো সেদিন সবার। যে কারণে আমরা দ্রুত গতিতে হাঁটতে পারিনি। বিশ্রাম বিরতি নিয়েছি বেশি। বিশ্রামে বেশি সময় নিলেই অ‍্যাডমিন ভাই আবার তাড়া দিতেন। এভাবেই হাঁটছি, বসছি, ঢালু থেকে নামছি-উঠছি, পাইন ছায়ায় দাঁড়াচ্ছি। আর যত এগিয়ে যাচ্ছি ততো বেশি উঁচু উঁচু পর্বত গিরি পেছনে ফেলে যাচ্ছি কিংবা পাশ কাটিয়ে সামনে এগোচ্ছি। সব দিকেই তখন উঁচু পর্বত চূড়া। খালি চোখে তাদের দেখা যায় না বটে। তাদের দিকে তাঁকাতে চাইলে অতিবেগুনী রশ্মি প্রতিরোধী দৃষ্টি সহায়ক কাঁচ লাগবে অবশ‍্যই। না হলে তাদের রূপের এতো তেজ যে তাদের থেকে চোখ নামানো মাত্রই নয়ন দু’জোড়া অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পায় না। সূর্যের কিরণ যেন এক একটি পর্বতের স্বর্ণালঙ্কার। স্বর্গের এক একটি সোপান নেমে এসেছে যেন আমাদেরকে স্বর্গদ্বারে পৌছে দিতে। কোন সোপান রেখে যে কোন সোপানে পা রাখি দ্বিধাগ্রস্ত হলাম। সবই এতো সমান সুন্দর হয় যে কিভাবে! যাই হোক এ পর্যন্ত এসে আমার মনে হয়েছিলো সামনে আর জনমানব কিছু নেই হয়তো। ঠিক তখন দুপুর গড়ায় প্রায় এমন সময়ে আরেকটি নেপালি গ্রামের দেখা পেলাম। ধিকুরপোখারি নামক সেই গ্রামে হোম স্টে থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট ও আছে। আমরা গঙ্গাপূর্ণা হোটেল এন্ড অরগানিক ক‍্যাফে তে চা, বিস্কুট, ম‍্যাঙ্গোবার আর পানিতে গলা ভিজিয়ে ক্ষুধা চাপা দিলাম। কারণ এখানে মধ‍্যাহ্নভোজ করতে চাইলে ওদিকে আপার পিসাং পৌছাতে রাত হয়ে যাবে। আর সবাই বলছিলো রোদ থাকা অবস্থায় পরের গন্তব্যে না পৌছাতে পারলে অসুবিধা হবে। সূর্য আড়াল হতেই নাকি ঠান্ডা হাওয়া ছুটবে। যাতে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্ষুধা চাপা দিয়েই পা বাড়িয়ে দিলাম। তখনও প্রায় অনেকটা পথ বাকি। ধিকুরপোখারি হল উত্তর-মধ্য নেপালের গন্ডাকি প্রদেশের কাস্কি জেলার একটি শহরতলী। আমরা এখন ৩২৪০ মিটার উপরে ব্রাহতাং থেকে সাড়ে পাঁচ কিমি পথ ট্রেক করে ধিকুরপোখারি। আরও সাড়ে চার কিমি পর মিলবে লোয়ার পিসাং। তারও উপর আপার পিসাং। এই মুহূর্তে সমতল কোন একটা জায়গায় এসে পৌছেছি। একটা ছোটখাটো পুকুর ডোবা তারই পাশ দিয়ে ফসলী জমির ন‍্যায় বহু খানিকটাই চলে গেছে। সূর্য তখন চূঁড়ার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। যদিও ঘড়ির কাঁটা বলছে সন্ধ্যা হতে আরও দেরী কিন্তু পাহাড়ি পথ তা মানতে নারাজ। সে তাড়া দিয়েই যাচ্ছে। বেলা তখন আনুমানিক তিনটা সাড়ে তিনটার মাঝে। ঠিক এর পরপর ঠান্ডা হিম শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে। শীতের কাপড়ে ভালো করে মুড়ে এগিয়ে চলছি আরও দ্বিগুন গতিতে। হৃদপিন্ড উত্তেজিত, জ্বীব কাঠের ন‍্যায় শক্ত আর হাত দু’টো অনড়, পা যেন পাথর খন্ড। সারাদিনের জন‍্য বরাদ্দকৃত শক্তির এই বুঝি শেষ। নিভু নিভু বাতির ন‍্যায় চলছে পায়ের পাতা। এইতো লোয়ার পিসাং আর আপার পিসাং এর মাঝামাঝি এখন। একটা ম‍্যাপ দেখতেও পাচ্ছি। স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েও নিতে পারলাম না। এইতো আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যায় টাওয়ারটা দেখিয়েও গাইড দাদা বললো, এখনও নাকি আধা ঘন্টা বাকি। ঠিকই বলেছিলো লাগলো সময় তারও একটু বেশি। পিসাং এর টিলার উপর মিনা দির ফায়ার প্লেসে এখন। ক্ষুধার্ত প্রাণ ভুলে গেল যে তার কোনো ক্লান্তি আছে আর। শুধু খাবার পেলেই হলো। নুডুলস খেয়ে চাঙ্গা এবার। সম্বিত ফিরে দেখি পিঠের পেছনে সাদা পাহাড় আমার দিকেই তাকিয়ে। মন বলছে তাহার পায়ের নিচেই আমাদের আশ্রয় হয়েছে। এই সৌন্দর্য দেখার সুখ ভাষায় প্রকাশিত হবার নয়। এ শুধু নিজস্ব মনের আনন্দ। এতো নিবেদন আবেদন প্রেম পরিণয় পর্যন্তও জানিনা তখনও যে সেই অন্নপূর্ণা-২, যার পদপ্রান্তেই লোয়ার পিসাং আর কোলঘেঁষে মিনা দির হোম স্টে। আজ আছি এখানেই ৩৩৬০ মিটার উচ্চতায়। চামে থেকে পনের কিমি পথ এসেছি আট ঘন্টায়। যেখানে সাধারণত ৬ ঘন্টায় পৌছানো যায়। আমার কাছে অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেক এর অন‍্যতম সুন্দর ট্রেইল ছিলো এইদিন (চামে টু আপার পিসাং)। আজ আছি মিনা দির হোটেল মানডালা এ‍্যান্ড অরগানিক ক‍্যাফে তে। আসছি পরের সকালে…

 

.© আমিনা লোপা

 

পর্ব- ৭
গগন ছোঁয়া মিনা দি’ র
আতিথেয়তা ৬ই/৭ই নভেম্বর, ২০২১ইং
মধ‍্যাহ্ন ভোজ হলো বিকাল সাড়ে ৪টারও পর। সন্ধ‍্যার আবছায়া আলো তখন জানালার কাঁচে। কনকনে ঠান্ডা যেন আরও বাড়ছে। রুমের ভেতর ব‍্যাগপত্র রেখেই দৌড়ে কাঁচে ঘেরা ডাইনিং টেবিলে। চলছে চা আড্ডা, কার কি অনুভূতি শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে একে একে গোসল সেরে কেউ হাত মুখ ধুয়ে এসে গুছিয়ে নিলাম কোনোরকমে। ভাগ‍্য ভালো গরম পানির ব‍্যবস্থা ছিলো। না হলে গোসল করার দুঃসাহস হতো না হয়তো। রীতিমতো নামাজ আদায় করলাম ঠকঠকিয়ে। শুকরিয়া আদায় করলাম যে আমরা নিরাপদে আজ এই পর্যন্ত পৌছেছি। আগামীকালও আমাদের অনুকূলে থাকুক। তারপর রাতের খাবারে মিনা দির আয়োজন দেখে আমরা সত‍্যি চরম খুশি।কারণ এখানে এতো ভালো কিছু আশা করিনি। দুইরকম সবজি, ডাল, ভাত, চাটনি। রান্না এবং খাবারের স্বাদে যদিও ভিন্নতা ছিলো তবুও খারাপ লাগেনি। তারচেয়ে বরং মন কেড়েছে মিনা দি’র গগন ছোঁয়া আতিথেয়তা, আন্তরিকতা। মনে হয়েছে নিজের দেশেই কোথাও বেড়াতে এসেছি। আফসোস মিনা দি অতিথি আপ‍্যায়নে এতো ব‍্যস্ত ছিলো যে তার কোনো ছবি আনতে পারিনি। তবে মানুষটির ছবি মনে আঁকা আছে। রাত যত বাড়তে থাকলো আমরা শীতের তীব্রতা ততো বেশি অনুভব করছি। এ‍্যাডমিন আকরাম ভাই জিজ্ঞাসা করলেন কারও কোনো ধরনের শারিরীক সমস‍্যা যেমন মাথা ব‍্যথা বা বমি ভাব হচ্ছে কিনা। কারণ আমরা এখন অনেক উঁচুতে অবস্থান করছি। অক্সিজেন কমে যেয়ে এসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এখানে মাথা ব‍্যথা একটা বড় চিন্তার কারন। বনির হালকা মাথা ব‍্যথা থাকায় এসিমক্স আর নাপা ঔষধ দিলেন এ‍্যাডমিন। সম্ভবত প্রচন্ড ঠান্ডার জন‍্য। তবুও রিস্ক নিতে চাননি কেউ। টিম এর বাকী দু’জন শাকিল ভাই, তন্নি সমস‍্যা শুরুর আগে থেকেই শুরু করেছিলেন। আমার টেনশন হচ্ছিলো বনিকে নিয়ে। যা পরে ছিলাম শীতের কাপড় তাই পরেই শুয়ে পড়লাম। রাতে খুব ভালো গভীর ঘুম হলোনা। হয়তো প্রচন্ড ঠান্ডা কিংবা টেনশন কিংবা হাই এ‍্যালটিটিউড। কিন্তু বনি ঠিকঠাক ই ছিলো আলহামদুলিল্লাহ্। পরের দিন ৭ই নভেম্বর ভোর বেলা ঘুম ভাঙার পর জানতে পারলাম ওর ঘুম হয়েছে। মাথা ব‍্যথাটাও নেই। আলহামদুলিল্লাহ্। জানালায় অন্নপূর্ণা ২ এর নতুন রূপে বিমোহিত হয়ে পড়লাম। নিচে লোয়ার পিসাং স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কি চমৎকার একটি ভোর যা যতগুলো ভোরে মনে করাবে ততোগুলো ভোর সুন্দর হয়ে যাবে শুধু চিন্তাতেই। এই সৌন্দর্যও মনের ঝুলিতে স্থান করে নিলো আজীবনের জন‍্যে। ঝটপট আনুষঙ্গিক কাজকর্ম যেমন হাত মুখ ধোয়া, নামাজ, কিছু জিনিসপত্র কমিয়ে ব‍্যাগ হালকা করার চেষ্টা, পরবর্তী ট্রেকিং এর জন‍্য প্রস্তুত হওয়া। আজ গতকালের চেয়ে অনেক বেশি ঝরঝরে অনুভূতি, কনফিডেন্স বেশি, ব‍্যাগপ‍্যাক কিভাবে নিলে আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবো সেই প্রক্রিয়া অটোমেটিক‍্যালি নিজেদের মধ‍্যে তৈরি হয়েছে বুঝতে পারছি। টিবেটিয়ান ব্রেড, মধু, ডিম ভাজি আর চা দিয়ে নাস্তা শেষ করে ক‍্যাফের ছাদে কিছুক্ষণ ফটোসেশন হলো। তারপর বেরিয়ে পড়লাম। আজকের গন্তব‍্য মানাং….

 

পর্ব- ৮ স্বর্গভূমি
মানাং সড়ক
৭ই নভেম্বর, ২০২১ইং

মিনা দির হোটেল পেছনে রেখে সামনে অন্নপূর্ণা-২, নিচে মানাং পৌছাবার পথ বেয়ে নামছি। আপার পিসাং থেকে লোয়ার পিসাং দৌড়ে দৌড়ে আজ নেমে আসলাম কত সহজে এবং কম সময়ে। গতকাল ছিলো ওঠার পথ আর এই পথ বেয়ে উঠতেই সময় আর শক্তি লেগেছিলো দ্বিগুনেরও দ্বিগুন। লোয়ার পিসাং এবং আপার পিসাংকে কেবলমাত্র পিসাং ই বলা যায়। আর দুটি পিসাং কে প্রাকৃতিক ভাবে প্রকৃতিই আলাদা করে রেখেছে বরাবর আমাদের সাথে বয়ে চলা সেই মারশিয়াংদি নদীটিই। দু’টি পিসাং এর উচ্চতার তফাৎ এক দেড়শ মিটার প্রায়। তফাৎ আছে নাকি দুই পিসাং এর বসতি এবং ভাষাতেও। আপার পিসাং এ তিব্বতি এবং লোয়ার পিসাং এ আছে টোঙ্গা নামে নতুন অভিবাসী । আর দুই পিসাং বাসীর সকল ভিন্নতাকে এক করেছে একটি সাসপেনশান ব্রীজ। সাসপেনশান ব্রীজ পার হয়ে দেখা হলো এক বৌদ্ধ মন্দিরের। এখান থেকেই মানাং এর শুষ্ক আর সমতলভূমির শুরু। মানাং পৌছানোর দুইটি পথ ছিল। একটি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নালি গুহা এবং অন্যটি ইয়াকটং এর দীর্ঘ এবং উঁচু পথ। মানাং এর রাস্তা প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সজ্জিত। অনেক উপত্যকা এবং সুন্দর গোছানো গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করে যাচ্ছি যা আমাদেরকে তাদের সংস্কৃতি এবং লোকেদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বৌদ্ধ মন্দির, মন্দির এবং পর্বতমালা যাত্রায় এক বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে এবং পথের ক্লান্তি আর চাপ যেন কমিয়ে ফেলেছে। এখনও পাইন আর স্প্রুস আমাদের ছেড়ে যায়নি, পাশে পাশে পা মিলিয়ে, প্রখর সূর্যতলের ছায়া হয়ে সাথেই আছে। আমাদের দেশে শরৎ এর স্বচ্ছ শুভ্র নীল আকাশ যতোটা না পরিপাটি হয় তার চেয়েও অধিক স্বচ্ছতা আর শুভ্রতা নিয়ে মস্ত বড় আকাশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের এতো বিশালতা খুব কাছে থেকে এইতো প্রথম দেখা। এতো নীলের চ্ছটা আর মেঘের আঁকাআঁকি মনটা উদাস করে তোলে।লোয়ার পিসাং থেকে মানাং ট্রেকের দূরত্ব হল ১৫.৭ কিলোমিটার। সমস্ত সমতল ট্রেইল অতিক্রম করে মানং পৌঁছতে সাধারণত ৫ থেকে ৬ ঘন্টা সময় লাগে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বের হয়ে সাড়ে ৯টা নাগাদ চা বিরতি চলছে কয়েক সিঁড়ি উপরে ওঠে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে। প্রখর রোদ কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস। খটখটা রোদও সে হিম বাতাসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আকরাম ভাইয়ের মিডিয়াম সাইজের এক ফ্লাস্ক চা তে সবাই গলা গরম করে নিলাম। ঐ তপ্ত রোদে ধোঁয়া ওঠা সেই চা আমাদের দেশে হলে মুখে আগুন লেগে যেতো সত‍্যি। তারপর বেশিক্ষন বিশ্রাম নেয়া যাবে না থিওরি তে ঝটপট নামতে শুরু করলাম মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে। খালি হাতে ফিরিনি কিন্তু একদমই মন্দির থেকে। তারানা আর সজন ভাই গলায় পেঁচিয়ে নিয়ে এলো মন্দিরে ঝুলানো ঝলমলে কাপড়ের বৌদ্ধ প্রেয়ার ফ্ল‍্যাগ।মানাং নেপালের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫৪০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বেলা ১২টার মতো তখন। নরোধারা পেছনে রেখে এইবার হুমদে এয়ারপোর্টের কিছুটা আগেই আমরা আবার বিশ্রাম নিতে হোম স্টের মতোই এক রেস্টুরেন্টে বসে চা, বাদাম, খেজুরে ক্ষুধা নিবারন করলাম। চা খাওয়ার এক ফাঁকে খেয়াল হলো সানগ্লাসটা হারিয়ে ফেলেছি। আর তখনি এতো রোদ যে খালি চোখে তাকানোর জো নেই। এখনই সানগ্লাস হারিয়ে ফেললাম সামনের দিনগুলোতে এর চেয়েও ঢের বেশি রোদের তীব্রতা থাকবে। তখন তো অসম্ভব রোদচশমা ছাড়া হাঁটা। আর এইখানে কোথাও কিনতেও পাওয়া যাবে না। সজন ভাই ভরসা দিলেন তার কাছে এক্সটা রোদ চশমা আছে। কিন্তু আমার চোখে বড় হবে কিনা। তবে যাই হোক বড় হলেও উপায় নেই, পরতে তো হবেই।চশমা হারানোর মনবেদনা নিয়ে আমার চোখের তুলনায় বড় সাইজের সানগ্লাসটা পরেই বারবার ধরে চোখে তুলছি আর আস্তে আস্তে হাঁটছি। যখনই এয়ারপোর্টের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি সব মনবেদনা কোথায় মিলিয়ে গেল। সেই রূপ রং আকাশ বাতাস মেঘের গল্প পরের পর্বে ছবিসহ….

©আমিনা লোপা